পটিয়া (চট্টগ্রাম) থেকে সেলিম চৌধুরী
দক্ষিণ চট্টগ্রামে পটিয়া-চন্দনাইশ উপজেলাসহ পাহাড়ি অঞ্চল কাঞ্চননগর, হাশিমপুর, দোহাজারী, ধোপাছড়ি, পটিয়ার খরনা পুর্বঅঞ্চল কেলিশহর, হাইদগাও এখন পেয়ারা গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এখানকার শত শত পাহাড়ে পেয়ারা চাষ করে হাজার হাজার মানুষ তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নিয়েছেন। শত শত বেকার যুবক পেয়ারা ব্যবসায় স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের হাল ধরেছেন। পাশাপাশি পেয়ারা সংগ্রহ, পরিবহনেও কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আবার অনেকেই পেয়ারা চাষে শূন্য থেকে পরিণত হয়েছেন লাখপতি। কোনো ধরনের ক্ষতিকারক কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই পেয়ারা উৎপাদন হওয়ায় দেশ ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে এই পেয়ারার। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানকার পেয়ারা নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশে। কাঞ্চননগর এলাকায় পেয়ারা উৎপাদন বেশি হওয়ায় এখানকার পেয়ারার নামকরণও হয়ে গেছে কাঞ্চন পেয়ারা হিসেবে। এদিকে চাহিদার কারণে পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি বিপণন বিভাগ থেকে হিমাগার নির্মাণের ব্যাপারে ইতিমধ্যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং হিমাগার নির্মাণের জন্য জায়গাও খোঁজা হচ্ছে। তিনি বলেন, চন্দনাইশে ১ হাজার ৫০০ একর পাহাড়ে পেয়ারা বাগান আছে। এখানকার যেসব চাষি পেয়ারা চাষে পরামর্শ চান, আমরা তাদের সার ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রতি মৌসুমে চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চলে কমপক্ষে দুই হাজার এবং পটিয়ার পুর্ব অঞ্চল পাহাড়ে এক হাজার বাগানে পেয়ারা চাষ হয়। এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা সাইজে বড়, দেখতে সুন্দর, খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় দেশব্যাপী প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফলে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা ফাঁড়িয়ারা দূর-দূরান্ত থেকে এসে ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করেন। তাছাড়া চাহিদার কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বর্তমানে অল্প সংখ্যক পেয়ারা বিদেশেও রফতানি হচ্ছে বলে জানান পেয়ারা চাষের সাথে সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, চলতি মৌসুমে পেয়ারা উৎপাদন বেশি হয়েছে। দামও রয়েছে চড়া। সাইজ অনুযায়ী বর্তমানে প্রতিডজন পেয়ারা ৭০ থেকে ১০০ টাকা এর উপরে বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন রওশনহাটের বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এবং খরনা রাস্তার মহাসড়কে প্রতিদিন ভোরে বসে পেয়ারার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। এছাড়াও পটিয়ার শ্রীমাই পাহাড় এলাকার পেয়ারা বাগানের হাট বসে কমল মুন্সি হাট এলাকায় চক্রশালা রেলওয়ে স্টেশনে সকাালে লাল কাপড়ে মোড়ানো ২ পুঁটলি (এক ভার) পেয়ারা বর্তমানে ১৩শ থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এখানকার পেয়ারা চাষি ও শ্রমিকরা দলবেঁধে গভীর রাতে পেয়ারা সংগ্রহ করতে বাগানে চলে যান। গাছ থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে ভোরের আলো ফুটতেই শত শত শ্রমিক কাঁধে বহন করে ৭/৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পেয়ারার ভার নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সংলগ্ন এ অস্থায়ী বাজারে। এখান থেকে ফাঁড়িয়ারা পেয়ারা কিনে ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে সরবরাহ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এছাড়াও কাঞ্চননগর, কাঞ্চননগর রেলস্টেশন, খানহাট, বাদামতল, বাগিচাহাট, দোহাজারীতেও বসে পেয়ারার অস্থায়ী বাজার। বিক্রির নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় বাধ্য হয়ে পেয়ারা বিক্রেতারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে বসেই বিক্রি করেন। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যাতায়াত করার সময় দেখা যায় এমন চিত্র। আবার কাঞ্চননগর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত শত শত কিশোর ও যুবক পেয়ারা নিয়ে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মহাসড়কে চলাচলরত বিলাসবহুল গাড়ির যাত্রীদের কাছে ডজন হিসেবেও খুচরা বিক্রি করে। আর যাত্রীরাও গাড়ি থামিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে কিনে নেয় রসালো এই পেয়ারা। মোহাম্মদ আলী, আবু বক্করসহ কয়েকজন বাগান মালিক জানান, এ অঞ্চলটি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় কোনো ধরনের যত্নআত্তি ছাড়াই এখানে পেয়ারার প্রচুর উৎপাদন হয়। এখানকার পেয়ারা সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় হওয়ায় সারাদেশে এর চাহিদাও বেশি। তারা আরো জানান, পেয়ারা উৎপাদন হওয়া এসব পাহাড় সরকারি হওয়ায় প্রতিবছর খাজনা দিয়ে পেয়ারা চাষ করেন। খাজনা দিয়ে অনেক সময় পাহাড়গুলো বন্দোবস্তি নিতেও চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদন হওয়া সরকারি এসব পাহাড় চাষিরা যাতে স্থায়ী বন্দোবস্ত পায় সে দাবি জানিয়েছেন তারা। উপজেলার থোপাছড়ি ইউনিয়নের পশ্চিম ধোপাছড়ির চামাছড়ি এলাকার পেয়ারা বাগান মালিক মো. ইকবাল হোসেন জানান, একটু পরিচর্যা করলেই পেয়ারা গাছে ফলন আসে। এতে তেমন কীটনাশকও দিতে হয় না। পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িতদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সুদমুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হলে পেয়ারা চাষে আরো অনেকেই ঝুঁকে পড়বে। এতে বেকারত্ব দূর হবে অনেকের।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
